বুকজ্বলা ও অ্যাসিডিটি: কারণ ও প্রতিকার

অ্যাসিডিটিবর্তমানে বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত একটি অসুখের নাম যাকে আমরা গ্যাস্ট্রিক হিসেবে চিনে থাকি। আমাদের দেশে ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৩০ জন প্রতিনিয়ত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এর গবেষণায় উঠে এসেছে, পুরো পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত বুক জ্বলা এসিডিটির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু নাগরিক জীবনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চললেই বুকজ্বলা এসিডিটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

বুকজ্বলা ও অ্যাসিডিটি: কারণ ও প্রতিকার
অ্যাসিডিটি সমস্যায় প্রতিনিয়ত আমরা আক্রান্ত হই বলে একে একটা মামুলি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকলে আলসার তৈরি হতে পারে, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় পেপটিক আলসার হিসেবেও পরিচিত। তবে পেপটিক আলসার পাকস্থলী ছাড়াও পৌষ্টিকতন্ত্রের যেকোন স্থানেই হতে পারে। তাই বুক জ্বলা গ্যাস নিগর্মণ এর সমস্যা হলেই হুটহাট ওষুধ খেয়ে নেওয়া ঠিক নয়। বুকজ্বলা এসিডিটি এর কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন।


বুকজ্বলা অ্যাসিডিটি: কী এবং কেন হয়?

বুক থেকে গলা পর্যন্ত প্রদাহ এবং অস্বস্তিকে হার্টবার্ন বলা হয়ে থাকে। পাকস্থলী এবং খাদ্যনালির মাঝামাঝি একটি রন্ধ্রনিয়ন্ত্রক রয়েছে যা দিয়ে পাকস্থলীর অম্ল গলিয়ে খাদ্যনালী বেয়ে উপরে উঠে আসে। এতে করে খাদ্যনালী উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ফলশ্রুতিতে বুক জ্বালাপোড়া এবং এসিডিটি তৈরি হয়।

বুক জ্বলা এসিডিটির ফলে গলার ভিতরের অংশে জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে পারে। এবং বুক জ্বলা এসিডিটির কারণে যখন গলায় জ্বালাপোড়া হয় ঠিক সেই সময়ই ঝাল, টক বা লবণাক্ত কোনো তরলের অস্তিত্ব অনুভূত হতে পারে গলার ভেতরের অংশেই। এছাড়া বারবার ঢেকুর তোলা এসিডিটির একটি লক্ষণ। পাকস্থলীর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এমন খাবার গ্রহণ করলে এবং পিত্তথলিতে পাথর থাকলেও বুকজ্বলা এসিডিটি বেশি হয়।

শরীরের উপর প্রভাব

দীর্ঘদিন ধরে এসিডিটি সমস্যায় বুঝতে থাকলে শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। চলুন এসিডিটির কারণে শরীরে যেসব খারাপ প্রভাব পড়তে পারে তা জেনে নেই:

     ক্রমাগত কাশি হতে পারে।

     দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

     ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে।

     দীর্ঘদিন এসিডিটি থাকলে পেপটিক আলসার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

     নিশ্বাসের সাথে দুর্গন্ধ আসতে করে।

     খাদ্যনালীর টিস্যুতে খাদ্য খাওয়ার সময় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

     পেটের জ্বালাপোড়া অনুভূতি হওয়ার পাশাপাশি পেটের আস্তরণে ঘা তৈরি হতে পারে।

     পেটে শক্ততা বা গিট তৈরি হতে পারে, এবং খাওয়ার ইচ্ছা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে।

বুকজ্বলা অ্যাসিডিটির সাধারণ কারণ  

বুক জ্বলা এসিডিটির সাধারণ কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খাবার গ্রহণে অনিয়ম, অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা, দেরিতে খাওয়া এবং অতিরিক্ত তেল যুক্ত খাবার গ্রহণ করা। নিচে আমরা বুক জ্বালা এসিডিটির সাধারণ কারণ গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব:

খাবারের অভ্যাস

অনেকেরই গভীর রাতে খাবার খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে এবং সকালের নাস্তা গ্রহণ না করার অভ্যাস রয়েছে। এটি এসিডিটি বাড়ার একটি অন্যতম কারণ। আবার রাতে খাবার গ্রহণ করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লে খাবার পাকস্থলীতে যাওয়া পর্যন্ত বাঁধার সৃষ্টি করে। এসিডিটি থেকে বাঁচার জন্য খাওয়ার পর কিছুটা হাঁটাচলা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।


অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা

প্রচন্ড ঝাল জাতীয় খাবার খাওয়া, ধূমপান এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা, দিনের মধ্যে কয়েকবার চা, কফি অ্যালকোহল পান করা, এসপিরিন, ইবুপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করা, চকলেট খাওয়ার অভ্যাস এসিডিটি বাড়ার অন্যতম কারণ। আপনি যদি দীর্ঘদিন যাবত এসিডিটি সমস্যায় ভোগেন তাহলে এই অভ্যাসগুলো ত্যাগ করাই ভালো।

দেরিতে খাওয়া এবং অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার

সময় অনুযায়ী খাবার গ্রহণ না করে প্রতিবেলায় দেরিতে খাবার গ্রহণ করা এবং অতিরিক্ত তেল যুক্ত খাবার খাওয়া বুক জ্বালাপোড়া করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাতে ঘুমানোর অন্তত দুই ঘন্টা আগে খাবার গ্রহণ করুন এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে ভারী নাস্তা গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

স্বাস্থ্যগত কারণসমূহ

অনেকে খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চললেও স্বাস্থ্যগত কারনে বুক জ্বালাপোড়া এবং এসিডিটি সমস্যায় দীর্ঘদিন যাবৎ ভুগে থাকেন। নিচে বুক জ্বালাপোড়া এবং এসিডিটির হওয়ার স্বাস্থ্যগত কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো:

গ্যাস্ট্রিক সমস্যা

গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা কমবেশি সবার রয়েছে। কিন্তু গ্যাস্ট্রিক হলেই যে বুক জ্বালাপোড়া হবে এর কোন প্রমাণ নেই। সাধারণত পেপটিক আলসার এর ফলেই বুকে পেটে জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে পারে।

পেপটিক আলসার

পেপটিক আলসার এর কারণে ফুসফুসের ক্ষুদ্র নালিগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমে যাই এবং নালির দেওয়াল মোটা হয়ে বাতাস প্রবেশের পথ সরু হয়। এতে করে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি বুক জ্বালাপোড়া করে।

হাইপোক্লোরহাইড্রিয়া

পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের ঘাটতিকে হাইপোক্লোরহাইড্রিয়া বলা হয়ে থাকে। শরীরের যাবতীয় খাদ্য হজম করতে, প্রোটিনের মত পুষ্টি শোষণ করতে হাইপোক্লোরহাইড্রিয়া এর ভূমিকা রয়েছে।


বুকজ্বলা অ্যাসিডিটির প্রতিকার

দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনলেই বুক জ্বলা এবং এসিডিটি থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া সম্ভব। অ্যাসিড রিফ্লাক্স থেকে পরিত্রাণের উপায় গুলো নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

     একবারে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করলে বুকজ্বলা এসিডিটি বাড়তে পারে। তাই অল্প অল্প করে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।


     রাতে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত তিন ঘন্টা পূর্বে ডিনার শেষ করার চেষ্টা করুন। রাতের খাবার গ্রহণ করে সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেলে এসিডিটি বৃদ্ধি পায়।


    কোমরে অতিরিক্ত মাত্রায় টাইট হয় এমন কোন পোশাক পরিধান করবেন না। ঢিলাঢালা পোশাক পরিধান করার চেষ্টা করুন।


     সকালের নাস্তায় ওটস রাখতে পারেন এসিডিটি থেকে বাঁচার জন্য, ওটস এর সাথে একটি কলা, টক দই মিশিয়ে খেলে সারাদিন বুক জ্বালাপোড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

     চা, কফি, কোমল পানীয়, মসুর ডাল, চকলেট, দুধ ইত্যাদি খাবার এসিডিটি বাড়াতে পারে। তাই বুক জ্বালাপোড়া অ্যাসিডিটি সমস্যা থাকলে এই খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন।


     সকালে খালি পেটে পানি পান করুন। তবে ২০০ মিলি লিটারের বেশি পানি পান না করাই ভালো।


     খালি পেটে আদা, পুদিনা পাতা, মেথি ভেজানো পানি খেলে এসিডিটি কমে,


     অ্যাসিডিটি কমাতে দুধ পান করুন, ভেষজ চা পান করুন, মুরগি ভেজে বা গ্রিল করে খাওয়া বন্ধ করুন।

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম

প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম বা ৪০ মিনিট দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করুন। কারণ নিয়মিত যোগব্যায়াম বা হাঁটাচলা করলে হজম প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়। এতে করে এসিডিটি নিয়ন্ত্রণে আসে।

ওষুধের ব্যবহার

এসিডিটি সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সারজেল ২০ মিলিগ্রাম (Sergel 20ক্যাপসুলটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ সুপারিশ করে থাকেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত এবং আপনার শারীরিক পরিস্থিতির সম্পর্কে অবগত না হয়ে সারজেল ২০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলটি সেবন করা উচিত নয়।


প্রাকৃতিক প্রতিকার

অনেক সময় ভেষজ চিকিৎসা এবং ঘরোয়া কিছু টোটকা ব্যবহার করেও এসিডিটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। চলুন এসিডিটি থেকে বাঁচার জন্য এসিডিটির প্রাকৃতিক প্রতিকার গুলো জেনে নেই:

ভেষজ চিকিৎসা


পেপারমিন্ট চা, জ্বাল করা ঠান্ডা দুধ, মৌরি বীজ এসিডিটি কমাতে সাহায্য করে। উষ্ণ গরম পানির সাথে দারুচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন। দিনে অন্তত তিনবার এই পানীয় পান করলে এসিডিটি থেকে চিরতরে আরাম মিলবে। এসিডিটি বাড়লে মুখে সর্বদা লবঙ্গ রাখুন। এতে করেও অ্যাসিডিটি সমস্যা কিছুটা কমবে।

ঘরোয়া প্রতিকার যেমন জিরা, তুলসি পাতা, এবং আদা

     এক কাপ পানিতে পরিমাণ মতো জিরা গুড়া এবং ধনিয়া গুড়া মশিয়ে পান করলে ভার্সিটি থেকে আরাম পাবেন।


     দিনে যতবার চা পান করবেন ততবারই চা এর মধ্যে কয়েকটি তুলসী পাতা দেওয়ার চেষ্টা করুন, এতে করে এসিডিটি কমবে।


     সকালে ঘুম থেকে উঠে আধা ভেজানো পানি, কাঁচা আদা চিবিয়ে খেলে উপকার পাবেন।


কখন ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন?


অ্যাসিডিটি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। দীর্ঘদিন শরীরের ভেতর এসিডিটি বাড়তে থাকলে শারীরিক বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য সমস্যা তৈরি হবে।

মারাত্মক বুকজ্বলা বা দীর্ঘস্থায়ী অ্যাসিডিটি

মারাত্মক বুক জ্বলা বা দীর্ঘস্থায়ী এসিডিটি হলে এবং ঘরোয়া প্রতিকার কাজ না হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসা

এসিডিটি প্রবল আকার ধারণ করলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পর যদি ডাক্তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার এবং চিকিৎসার পরামর্শ দেন অবশ্যই তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন। এসিডিটির জন্য ডাক্তার মল পরীক্ষা করতে পারেন, এন্ডোসকপি করতে পারেন, রক্তের হিমো-9গ্লোবিন পরীক্ষা করতে পারেন।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, বুকজ্বলা অ্যাসিডিটি এর কারণ, বুকজ্বলা অ্যাসিডিটি থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায়, বুকজ্বলা এসিডিটি কি এবং কেন হয় ইত্যাদি তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আর্টিকেল। বুকজ্বলা এবং এসিডিটি সম্পর্কে আপনাদের আরো যদি কোন জিজ্ঞাসা মতামত থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান। এবং এরকম আরো তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url